

তার কন্ঠে জাদু হাতে সোনা। যেখানেই তিনি হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। আর আপদমস্তক ভদ্রলোক এই মানুষ টি এসব খ্যাতি আর সম্মানকে বিনয়ের সাথে গ্রহণ করে ফিরে গেছেন কাজের জগতে। সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি শান্তি আর ভালোবাসার বাণীই কেবল ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তার হাত ধরেই গোল্ডেন গ্লোবের আসরে ভারতবাসী জয় করলো প্রথম পদক। সঙ্গীত জাদুকর এ আর রহমান এবার স্বপ্ন দেখাছেন আস্কারের।’০৪ সালের ৩ মে তারিখের সংখ্যায় বিশ্বখ্যাত সাময়িকী ‘টাইম’ তাকে ‘মোজার্ট অফ মাদ্রাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তারা সেই সংখ্যায় জানিয়েছিল যে ‘লেনন-ম্যাকার্টনির সঙ্গে একই কাতারে দাঁড়ানোয় সক্ষম এই তুমুল প্রতিভার গানে উচ্ছ্বাস, প্রেম, দ্রোহ- সবই আছে’। তাদের সেদিনের সেই ভবিষ্যতবাণী যে মোটেও মিথ্যা নয়, সেটা প্রমাণ করেছেন তিনি তার আগেও, পরেও। আর এক প্রখ্যাত পরিচালক মনিরত্নমও কী ভেবেছিলেন, একজন সাধারণ মানুষকে অসাধারণ ভেবে তিনি যে তুলে আনছেন- সে দিনে দিনে এতোটাই অসাধারণ হবে! অথচ ভারতের কোটি কোটি নানা বর্ণের, পেশার, শ্রেণীর মানুষকে খুশির জোয়ারে একেবারে ভাসিয়ে দিয়ে এ আর রহমান নামের বিনয়ী, লাজুক প্রকৃতির শুধু কাজপাগল এক সঙ্গীত জাদুকর তাদের জন্য বয়ে এনেছেন নতুন বছরের একেবারে প্রথম দিকে এক দারুণ সম্মান। ৬৬ তম গোল্ডেন গ্লোবের আসরে খোদ আমেরিকার বেভারলি হিলসে গিয়ে তিনি জয় করে এনেছেন ‘স্লামডগ মিলিয়ানেয়ার’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ‘সেরা সঙ্গীত পরিচালক’- এর সম্মান। আর এখন অনেকেই আশা করছেন আসছে অস্কার আসরের বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কারটা তিনিই পাবেন।ছবির ভুবনে যেমন এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন- নিজের বাস্তব জীবনে কিন্তু সেটা করতে পারেননি মোটেও এ আর রহমান। খুবই কষ্টে কেটেছে তার ছেলেবেলা।
জন্ম ’১৯৬৬ সালের ৬ই জানুয়ারি ভারতের চেন্নাইতে। এ এস দিলীপ কুমার নামে জন্ম নেয়া এই ছেলেটির বাবা আর কে শেখরও ছিলেন একজন পরিচালক। তিনি ছিলেন কেরালার ছবির সঙ্গীত পরিচালক এবং একজন বাদক। মাত্র ৪ বছর বয়সে দিলীপ পিয়ানো বাজানো শুরু করে। তবে মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর তাকে কঠিন পৃথিবীতে উপার্জনের সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়। মাদ্রাজ থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত গান নিয়ে এই সঙ্গীত পরিব্রাজক তবলার জাদুকর ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে বিশ্বের নানা প্রান্তে বাজিয়েছেন। ’১৯৮৯ সালে তাদের পুরো পরিবার হিন্দুধর্ম ছেড়ে ইসলামের সুফি মতাদর্শে দীক্ষিত হলে দিলীপ নিজের নাম রাখেন আল্লা রাখা রহমান খান। বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্টিনিট্টি কলেজ অফ মিউজিক থেকে ওয়েষ্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ওপর গ্রাজুয়েশন করার পর রহমান ফিরে আসেন নিজ দেশ ভারতে। এখানে তিনি মাদ্রাজের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় জিঙ্গেল লেখকের চাকুরী নেন। ‘মাদ্রাজের মোজার্ট’ ‘বম্বে ডাইং’ নামের একটি বিজ্ঞাপনের কাজের মাধ্যমে চারদিকে সাড়া ফেলে দেন। আর এটাই তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই বিখ্যাত পরিচালক মনিরত্নম তার তামিল ছবি ‘রোজা’র সাউন্ডট্র্যাক এবং সঙ্গীত পরিচালনার জন্য রহমানকে আমন্ত্রণ জানান। এই ছবিতে তার কাজ সবাইকে এতো বেশি মুগ্ধ করে যে, প্রথমবারের মতো কোনো নতুন অভিষিক্ত সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে রহমান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন। এক সময়ের সুপার হিট ছবি ‘রঙ্গিলা’ র সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বলিউডি দুনিয়ায় যাত্রা শুরু করেন রহমান। এই ছবির গানগুলো প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায় এবং এরপর বিরতিহীনভাবে এই ‘মিউজিক জিনিয়াস’ একে একে দারুণ উপহার দেন ‘বম্বে’, ‘দিল সে’, ‘লগান’ এবং ‘রঙ দে বাসনি-’ প্রভৃতি ছবির অসাধারন সব সঙ্গীত।‘ছাইয়া ছাইয়া’র গানের ‘দিল সে’ ছবির সুপারহিট কম্পোজিশনটি রহমানের জীবনে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ' ১৯৯৮ সালে করা এই গানের ভেতরে সুফিবাদের গভীর ছাপ রয়েছে, যা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আর ছবিটি টেলিভিশনের পর্দায় দেখেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন প্রবাদপ্রতীম থিয়েটার পরিচালক এন্ড্রু লয়েড ওয়েবার। এই বিখ্যাত মানুষটি তার ‘ছাইয়া ছাইয়া’ গানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। লয়েড এই মানুষটিকে খুঁজে পাবার সঙ্গে সঙ্গে শুধু একজন উদ্ভাবনী পরিচালকের দেখাই পাননি, পেয়েছেন নানা সমস্যার সমাধানকারীকেও। কারণ রহমান প্রায় সব সঙ্গীতযন্ত্রই অবলীলায় বাজাতে পারেন এবং তার দক্ষতাও অতুলনীয়। ফলে ’২০০২ সালে তিনি প্রথম স্টেজ প্রোডাকশন হিসেবে ‘বম্বে ড্রিমস’- এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই কাজ তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করে এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে যায় লন্ডনের ওয়েষ্ট- এন্ড থেকে নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতেও! ওয়েষ্ট- এন্ডে কাজ করার জন্য তিনি ‘লরেন্স অলিভিয়ের’ পদক লাভ করেছেন। নিজের যতো বেশি বিকাশ তিনি ঘটিয়েছেন, তত বেশি আন্তজাতিক পরিমন্ডলে এই ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালকের খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। তিনি পপ গানের রাজা মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে একত্রে ’১৯৯৯ সালে ‘মাইকেল জ্যাকসন এন্ড ফ্রেন্ডস’ নামের একটি কনসার্টে পারফর্ম করেন জামার্নির মিউনিখে। আবার, ’০৪ সালে তিনি ফিনল্যান্ডের ফোক গানের দল ‘ভাট্রিনা’র সঙ্গে মিলে ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ থিয়েটার প্রডাকশনের জন্য কাজ করেন। বৃটিশ পরিচালক ড্যানি বয়েলসের ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ ছবিতে ‘জয় হো’ গানের কম্পোজিশনের জন্য রহমান ’২০০৮ সালের সেরা সমালোচক এবং একটি গোল্ডেন গ্লোব পদক লাভ করেন ‘বেষ্ট অরিজনাল স্কোর’ বিভাগে।চারবারের জাতীয় পদক জয়ী রহমান পেয়েছেন আরো অনেক অনেক পদক এবং খেতাব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পদক। আর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার জন্য তিনি ৬ বার ‘তামিলনাড়ু স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’ এবং ১১ বার পেয়েছেন ‘ফিল্মফেয়ার’ পদক।’২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্টার্নফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সারাবিশ্বের সঙ্গীতে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করে। আর ’১৯৯৫ সালে তিনি গ্রহণ করেন মরিশাসের জাতীয় পদক এবং মালয়শিয়ার জাতীয় পুরষ্কার। রহমানের জাদুটা এখানেই , তার পরিবেশনার মধ্যে বাদ্যযন্ত্রেও যে চনমনে ব্যবহার আছে সেটা শ্রোতাকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে। আর এগুলোর বেশিরভাগই ভারতীয় ফোক ছবির অনুপ্রেরণা থেকে তৈরি করেন তিনি। তিনি তার সঙ্গীত পরিচালনায় মধ্যে তুলে এনেছেন পশ্চিমের ক্লাসিকাল ধরণ ও ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারা, কাওয়ালি গানের নানা সুর ইত্যাদি অনেক কিছু। তিনি অবলীলায় বাজাতে পারেন পিয়ানো, সিন্থেসাইজার, গিটার এবং হারমোনিয়াম।রহমানের আজকের এই অবস্থার আসার পেছনে যারা অবদান রেখেছেন, মানে যাদের শিষ্যত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে তারা হলেন- এম এস বিশ্বনাথন, রমেশ নাইডু, ওস্তাদ জাকির হোসেন, এল শংকর- প্রমুখ বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্বরা।ব্যক্তিগত জীবনে সায়রা বানু আর রহমানের তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। খাদিজা, রহিম এবং আমান তাদের নাম। দক্ষিণ ভারতের অভিনেতা রাশিন রহমান এবং সঙ্গীত পরিচালক জে ভি প্রকাশ কুমারের তিনি আত্মীয়। এই দারুণ বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় পরিচালকের ছবির সুর করা গানের ১০০ মিলিয়নেরও বেশি রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। আর ক্যাসেট বা সিডি বিক্রি হয়েছে সারাবিশ্বে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি। ফলে তিনি হয়েছেন সর্বকালের সেরা ১০ রেকর্ডিং আর্টিস্টদের একজন। যদিও তিনি নিজেই টাইম ম্যাগাজিনকে প্রদান করা এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ সর্ম্পকে বলেছিলেন, “এটা একটা আনুমানিক হিসেব। আপনার যদি হিট ছবি থাকে তাহলে সেটার ৫ থেকে ৫ মিলিয়ন সিডি বিক্রি হবে। আর আমার কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ টা ছবি আসলেই খুব বেশি হিট হয়েছে।” পাইরেটেড সিডি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তখন মন্তব্য করেন, “ভারতে আমরা কোনো স্বত্ব্ব পাই না ক্যাসেট বিক্রি থেকে। যদি এটা ঘটতো তাহলে আসলেই আমি খুব ধনী ব্যক্তি হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি তো আমেরিকায় জন্ম নিই নি।”‘লগান’, ‘কাভি না কাভি’, ‘দিল সে’, ‘স্বদেশ’, ‘ওয়াটার’, ‘রঙ দে বাসন্তি’, ‘যুবরাজ’, ‘গজিনী’ প্রভৃতি তুমুল বিখ্যাত ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করে রহমান নিজেকে ভারতের সেরা সঙ্গীত পরিচালকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি তামিল, মালায়লাম, তেলেগু, কানাড়া ও ইংরেজি ভাষার ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছেন।এ আর রাহমান গোল্ডেন গ্লোব পুরষ্কার লাভের পর প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেছেন, “তিনি সঙ্গীতের প্রতিটি বিটকে ধারণ করেন। আমি তার সঙ্গে আমার অন্যতম সেরা কাজটিই করেছি। এটা ছিল ‘দিল সে’ ছবি। এরপর আমরা একে একে কাজ করেছি ‘লগান’, ‘রঙ দে বাসন্তি এবং আরো কয়েকটি ছবিতে। আমি তার অর্কেষ্টাবাদন পছন্দ করি। তিনি সুর করেন সহজ এবং ভাবপূর্ণভাবে। তার করা সুরের মধ্যে আমার প্রিয় গান হলো, ‘জিয়া জ্বলে’। এটা ‘দিল সে’ ছবিতে আমি তার জন্য গেয়েছিলাম।” আর লতারই বোন আরেক প্রতিথযশা শিল্পী আশা ভোঁশলে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, “তিনি আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছেন। আমি তার সঙ্গে প্রথম কাজ করি ‘রঙ্গিলা’ ছবিতে। তিনি সব সময় বলতেন যে, নিজের সঙ্গীত নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যেতে চান। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য কেবল নিজের কাজেই মনোযোগ ছিল তার।”তবে নিজের কাজ সম্পর্কে এ আর রাহমান কোনো অহমিকা প্রকাশ করেন না কখনোই। এই লাজুক এবং রীতিমতো ভদ্রলোক তার ছবিতে করা কাজের সম্পর্কে বলেছেন, “আমি আসলে ছবির গানকে তৈরি করতে চেয়েছি। চেয়েছি এটা যেন ছড়িয়ে যায়। সেটা ভাষা বা সংস্কৃতি যেটার ভেতর দিয়েই হোক না কেন।”ভারতের বিখ্যাত স্বদেশী গান ‘বন্দে মাতরম’ কে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন এ আর রহমান। আর তার সাম্প্রতিক ট্র্যাক ‘জয়া সে জয়া’ তে তিনি গানের মাধ্যমে ভালোবাসা এবং শান্তির বাণী ছড়িয়েছেন সকলের মাঝে। এটাই তিনি সব সময় করতে চেয়েছেন। আর ’০৮ সালে তিনি কাজ করেছেন ‘জানে তু ইয়া জানে না’, ‘যুবরাজ’, ‘গজিনী’ এবং ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ ছবিতে। নিজের কথা এবং ধরণ তিনি সামনে তুলে ধরবেন ‘দিল্লী ৬’, ‘ব্লু’ ছাড়াও আরো বাকীসব কাজ এবং ছবিতেও, নিশ্চিত!
জন্ম ’১৯৬৬ সালের ৬ই জানুয়ারি ভারতের চেন্নাইতে। এ এস দিলীপ কুমার নামে জন্ম নেয়া এই ছেলেটির বাবা আর কে শেখরও ছিলেন একজন পরিচালক। তিনি ছিলেন কেরালার ছবির সঙ্গীত পরিচালক এবং একজন বাদক। মাত্র ৪ বছর বয়সে দিলীপ পিয়ানো বাজানো শুরু করে। তবে মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর তাকে কঠিন পৃথিবীতে উপার্জনের সংগ্রামে নেমে পড়তে হয়। মাদ্রাজ থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত গান নিয়ে এই সঙ্গীত পরিব্রাজক তবলার জাদুকর ওস্তাদ জাকির হোসেনের সঙ্গে বিশ্বের নানা প্রান্তে বাজিয়েছেন। ’১৯৮৯ সালে তাদের পুরো পরিবার হিন্দুধর্ম ছেড়ে ইসলামের সুফি মতাদর্শে দীক্ষিত হলে দিলীপ নিজের নাম রাখেন আল্লা রাখা রহমান খান। বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্টিনিট্টি কলেজ অফ মিউজিক থেকে ওয়েষ্টার্ন ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ওপর গ্রাজুয়েশন করার পর রহমান ফিরে আসেন নিজ দেশ ভারতে। এখানে তিনি মাদ্রাজের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় জিঙ্গেল লেখকের চাকুরী নেন। ‘মাদ্রাজের মোজার্ট’ ‘বম্বে ডাইং’ নামের একটি বিজ্ঞাপনের কাজের মাধ্যমে চারদিকে সাড়া ফেলে দেন। আর এটাই তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই বিখ্যাত পরিচালক মনিরত্নম তার তামিল ছবি ‘রোজা’র সাউন্ডট্র্যাক এবং সঙ্গীত পরিচালনার জন্য রহমানকে আমন্ত্রণ জানান। এই ছবিতে তার কাজ সবাইকে এতো বেশি মুগ্ধ করে যে, প্রথমবারের মতো কোনো নতুন অভিষিক্ত সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে রহমান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন। এক সময়ের সুপার হিট ছবি ‘রঙ্গিলা’ র সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বলিউডি দুনিয়ায় যাত্রা শুরু করেন রহমান। এই ছবির গানগুলো প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায় এবং এরপর বিরতিহীনভাবে এই ‘মিউজিক জিনিয়াস’ একে একে দারুণ উপহার দেন ‘বম্বে’, ‘দিল সে’, ‘লগান’ এবং ‘রঙ দে বাসনি-’ প্রভৃতি ছবির অসাধারন সব সঙ্গীত।‘ছাইয়া ছাইয়া’র গানের ‘দিল সে’ ছবির সুপারহিট কম্পোজিশনটি রহমানের জীবনে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ' ১৯৯৮ সালে করা এই গানের ভেতরে সুফিবাদের গভীর ছাপ রয়েছে, যা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আর ছবিটি টেলিভিশনের পর্দায় দেখেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন প্রবাদপ্রতীম থিয়েটার পরিচালক এন্ড্রু লয়েড ওয়েবার। এই বিখ্যাত মানুষটি তার ‘ছাইয়া ছাইয়া’ গানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। লয়েড এই মানুষটিকে খুঁজে পাবার সঙ্গে সঙ্গে শুধু একজন উদ্ভাবনী পরিচালকের দেখাই পাননি, পেয়েছেন নানা সমস্যার সমাধানকারীকেও। কারণ রহমান প্রায় সব সঙ্গীতযন্ত্রই অবলীলায় বাজাতে পারেন এবং তার দক্ষতাও অতুলনীয়। ফলে ’২০০২ সালে তিনি প্রথম স্টেজ প্রোডাকশন হিসেবে ‘বম্বে ড্রিমস’- এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই কাজ তুমুল আলোচনার সৃষ্টি করে এবং তার খ্যাতি ছড়িয়ে যায় লন্ডনের ওয়েষ্ট- এন্ড থেকে নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতেও! ওয়েষ্ট- এন্ডে কাজ করার জন্য তিনি ‘লরেন্স অলিভিয়ের’ পদক লাভ করেছেন। নিজের যতো বেশি বিকাশ তিনি ঘটিয়েছেন, তত বেশি আন্তজাতিক পরিমন্ডলে এই ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালকের খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। তিনি পপ গানের রাজা মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে একত্রে ’১৯৯৯ সালে ‘মাইকেল জ্যাকসন এন্ড ফ্রেন্ডস’ নামের একটি কনসার্টে পারফর্ম করেন জামার্নির মিউনিখে। আবার, ’০৪ সালে তিনি ফিনল্যান্ডের ফোক গানের দল ‘ভাট্রিনা’র সঙ্গে মিলে ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ থিয়েটার প্রডাকশনের জন্য কাজ করেন। বৃটিশ পরিচালক ড্যানি বয়েলসের ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ ছবিতে ‘জয় হো’ গানের কম্পোজিশনের জন্য রহমান ’২০০৮ সালের সেরা সমালোচক এবং একটি গোল্ডেন গ্লোব পদক লাভ করেন ‘বেষ্ট অরিজনাল স্কোর’ বিভাগে।চারবারের জাতীয় পদক জয়ী রহমান পেয়েছেন আরো অনেক অনেক পদক এবং খেতাব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ পদক। আর ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার জন্য তিনি ৬ বার ‘তামিলনাড়ু স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’ এবং ১১ বার পেয়েছেন ‘ফিল্মফেয়ার’ পদক।’২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্টার্নফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সারাবিশ্বের সঙ্গীতে অবদানের জন্য সম্মাননা প্রদান করে। আর ’১৯৯৫ সালে তিনি গ্রহণ করেন মরিশাসের জাতীয় পদক এবং মালয়শিয়ার জাতীয় পুরষ্কার। রহমানের জাদুটা এখানেই , তার পরিবেশনার মধ্যে বাদ্যযন্ত্রেও যে চনমনে ব্যবহার আছে সেটা শ্রোতাকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে। আর এগুলোর বেশিরভাগই ভারতীয় ফোক ছবির অনুপ্রেরণা থেকে তৈরি করেন তিনি। তিনি তার সঙ্গীত পরিচালনায় মধ্যে তুলে এনেছেন পশ্চিমের ক্লাসিকাল ধরণ ও ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারা, কাওয়ালি গানের নানা সুর ইত্যাদি অনেক কিছু। তিনি অবলীলায় বাজাতে পারেন পিয়ানো, সিন্থেসাইজার, গিটার এবং হারমোনিয়াম।রহমানের আজকের এই অবস্থার আসার পেছনে যারা অবদান রেখেছেন, মানে যাদের শিষ্যত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে তারা হলেন- এম এস বিশ্বনাথন, রমেশ নাইডু, ওস্তাদ জাকির হোসেন, এল শংকর- প্রমুখ বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্বরা।ব্যক্তিগত জীবনে সায়রা বানু আর রহমানের তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। খাদিজা, রহিম এবং আমান তাদের নাম। দক্ষিণ ভারতের অভিনেতা রাশিন রহমান এবং সঙ্গীত পরিচালক জে ভি প্রকাশ কুমারের তিনি আত্মীয়। এই দারুণ বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় পরিচালকের ছবির সুর করা গানের ১০০ মিলিয়নেরও বেশি রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। আর ক্যাসেট বা সিডি বিক্রি হয়েছে সারাবিশ্বে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি। ফলে তিনি হয়েছেন সর্বকালের সেরা ১০ রেকর্ডিং আর্টিস্টদের একজন। যদিও তিনি নিজেই টাইম ম্যাগাজিনকে প্রদান করা এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ সর্ম্পকে বলেছিলেন, “এটা একটা আনুমানিক হিসেব। আপনার যদি হিট ছবি থাকে তাহলে সেটার ৫ থেকে ৫ মিলিয়ন সিডি বিক্রি হবে। আর আমার কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ টা ছবি আসলেই খুব বেশি হিট হয়েছে।” পাইরেটেড সিডি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তখন মন্তব্য করেন, “ভারতে আমরা কোনো স্বত্ব্ব পাই না ক্যাসেট বিক্রি থেকে। যদি এটা ঘটতো তাহলে আসলেই আমি খুব ধনী ব্যক্তি হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি তো আমেরিকায় জন্ম নিই নি।”‘লগান’, ‘কাভি না কাভি’, ‘দিল সে’, ‘স্বদেশ’, ‘ওয়াটার’, ‘রঙ দে বাসন্তি’, ‘যুবরাজ’, ‘গজিনী’ প্রভৃতি তুমুল বিখ্যাত ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করে রহমান নিজেকে ভারতের সেরা সঙ্গীত পরিচালকের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি তামিল, মালায়লাম, তেলেগু, কানাড়া ও ইংরেজি ভাষার ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেছেন।এ আর রাহমান গোল্ডেন গ্লোব পুরষ্কার লাভের পর প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেছেন, “তিনি সঙ্গীতের প্রতিটি বিটকে ধারণ করেন। আমি তার সঙ্গে আমার অন্যতম সেরা কাজটিই করেছি। এটা ছিল ‘দিল সে’ ছবি। এরপর আমরা একে একে কাজ করেছি ‘লগান’, ‘রঙ দে বাসন্তি এবং আরো কয়েকটি ছবিতে। আমি তার অর্কেষ্টাবাদন পছন্দ করি। তিনি সুর করেন সহজ এবং ভাবপূর্ণভাবে। তার করা সুরের মধ্যে আমার প্রিয় গান হলো, ‘জিয়া জ্বলে’। এটা ‘দিল সে’ ছবিতে আমি তার জন্য গেয়েছিলাম।” আর লতারই বোন আরেক প্রতিথযশা শিল্পী আশা ভোঁশলে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, “তিনি আমাদের সবাইকে গর্বিত করেছেন। আমি তার সঙ্গে প্রথম কাজ করি ‘রঙ্গিলা’ ছবিতে। তিনি সব সময় বলতেন যে, নিজের সঙ্গীত নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যেতে চান। নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য কেবল নিজের কাজেই মনোযোগ ছিল তার।”তবে নিজের কাজ সম্পর্কে এ আর রাহমান কোনো অহমিকা প্রকাশ করেন না কখনোই। এই লাজুক এবং রীতিমতো ভদ্রলোক তার ছবিতে করা কাজের সম্পর্কে বলেছেন, “আমি আসলে ছবির গানকে তৈরি করতে চেয়েছি। চেয়েছি এটা যেন ছড়িয়ে যায়। সেটা ভাষা বা সংস্কৃতি যেটার ভেতর দিয়েই হোক না কেন।”ভারতের বিখ্যাত স্বদেশী গান ‘বন্দে মাতরম’ কে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন এ আর রহমান। আর তার সাম্প্রতিক ট্র্যাক ‘জয়া সে জয়া’ তে তিনি গানের মাধ্যমে ভালোবাসা এবং শান্তির বাণী ছড়িয়েছেন সকলের মাঝে। এটাই তিনি সব সময় করতে চেয়েছেন। আর ’০৮ সালে তিনি কাজ করেছেন ‘জানে তু ইয়া জানে না’, ‘যুবরাজ’, ‘গজিনী’ এবং ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ ছবিতে। নিজের কথা এবং ধরণ তিনি সামনে তুলে ধরবেন ‘দিল্লী ৬’, ‘ব্লু’ ছাড়াও আরো বাকীসব কাজ এবং ছবিতেও, নিশ্চিত!
Please visit vinnobasar sponsorer:
Taking care of your parents in Kolkata
No comments:
Post a Comment